November 23, 2024, 8:00 am

“স্থপতি” ছাড়াই চলছে বিল্ডিং ডিজাইন ফার্ম!

“স্থপতি” ছাড়াই চলছে বিল্ডিং ডিজাইন ফার্ম!

মেহেদী হাসান ॥
বরিশালের অধিকাংশ বিল্ডিং ডিজাইন ফার্ম স্থপতিদের যুক্ত না করেই বহুতল (৫ বা ততোধিক) ভবনের নকশা প্রনয়নের কাজ করে যাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। সরজমিনে পরিচয় গোপন করে বেশ কিছুদিন ধরে এই প্রতিবেদক বরিশালের অন্তত ১৬ টি বিল্ডিং ডিজাইন ফার্ম একাধিকবার পরিদর্শন করে এই তথ্যের সত্যতা পান। পরিদর্শন করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মাত্র ২টি প্রতিষ্ঠান ব্যাতীত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশ স্থপতি ইনিস্টিউটের পূর্ন সদস্য স্থপতির দেখা পাওয়া যায় নি।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ১৯৯৬ অনুযায়ী বহুতল (৫ তলার অধিক) ভবন নির্মাণের জন্য অবশ্যই স্থপতির সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে আর অন্যদিকে ইমারত নির্মান বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী যেকোন ধরনের এবং যেকোন উচ্চতার (১তলা কিংবা ততোধিক) ভবন নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ স্থপতি ইনিস্টিউটের পূর্ন সদস্য স্থপতি সম্পৃক্ততার বিষয় আবশ্যিক করা হয়েছে। আবার অন্যদিকে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে ১তলা থেকে ৪তলা ভবনের নির্মাণের পরামর্শক হিসেবে বাংলাদেশ স্থপতি ইনিস্টিউটের সহযোগী সদস্য স্থপতি এবং বহুতল (৫তলা বা ততোধিক) ভবনের নির্মাণের পরামর্শক হিসেবে বাংলাদেশ স্থপতি ইনিস্টিউটের পূর্ন সদস্য স্থপতি যুক্ত রাখার বিষয়টি রয়েছে। ঢাকা মহানগরসহ কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন এলাকা ব্যতিত বাকী সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় ভবন নির্মাণের জন্য ইমারত নির্মান বিধিমালা ১৯৯৬ প্রযোজ্য। সে হিসেবে বরিশাল নগরীতে যে কোন বহুতল (৫ বা ততোধিক) ভবন নির্মাণে স্থপতির সম্পৃক্ততার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বরিশালে অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ স্থপতি ইনিস্টিউটের সহযোগী/পূর্ন সদস্য স্থপতিদের সরাসরি যুক্ত না করেই বহুতল ভবন নির্মাণের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ বিল্ডিং ডিজাইন প্রতিষ্ঠান। সরজমিনে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে মাত্র ২টি প্রতিষ্ঠান ব্যতিত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে অবস্থানরত কোন বাংলাদেশ স্থপতি ইনিস্টিউটের সহযোগী সদস্য কিংবা পূর্ন সদস্য স্থপতির উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি নিয়ে নগরের নতুন বাজারের পোল সংলগ্ন সাউদার্ন নির্মান কনসালটেন্স এর প্রোপাইটর ইঞ্জিনিয়ার মো: শাহজাহান মিয়া বলেন, আসলে বরিশালে ভবন নির্মান ক্ষেত্রে স্থপতির তেমন কোন দরকার হয় না। আপনাদের প্রতিষ্ঠানে কোন নিয়োগপ্রাপ্ত স্থপতি রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি সদুত্তর দিতে না পারলেও জানান, তাদের প্রিন্স নামে একজন স্থপতি রয়েছে। কিন্তু তিনি তার বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট এর সদস্যপদ নম্বর বলতে পারেননি। এছাড়াও নগরের ফজলুল হক এভিনিউর জজ কোর্টের সম্মুখে এভারগ্রীন বিল্ডিং কনসালটেন্স এর ম্যানেজার জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানেও কোন নিয়োগপ্রাপ্ত স্থপতি নেই। তবে স্থপতি গোলাম মোস্তফা নামে এক ব্যাক্তি ঢাকা থেকে এসে বরিশালের ভবন নির্মানের পরমার্শ দেন। এবং তিনি কাজের সাইট পরিদর্শন করেন কিভাবে এমন প্রশ্নে তিনি জানান, স্থপতি মাঝে মাঝে আসেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, বরিশালে যারা বহুতল ভবনের ডিজাইন ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাদের বৃহত্তর একটা অংশই ঢাকার প্রতিষ্ঠান। তিনিও ওই স্থপতির সদস্যপদ নম্বর বলতে পারেননি। অপরদিকে নগরের গোড়াচাঁদ দাস রোড এর উইন্ডো বিল্ডিং ডিজাইন এন্ড আইডিয়া ও কংক্রিট বিল্ডিং ডিজাইন এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবে গত ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারী বিকেল ও সন্ধ্যায় গিয়েও প্রতিষ্ঠান গুলো তালাবদ্ধ দেখা গিয়েছে। এছাড়াও এবিষয়ে জানতে নগরের সদর রোডে আবির ডিজাইন নামক প্রতিষ্ঠানটির মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভবনের ডিজাইনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশার নাম আর্কিটেক্ট বা স্থপতি। এমনকি বাংলাদেশের চলমান ভবন নির্মাণ আইন সমূহতেও বহুতল ভবনের নকশা প্রনয়ণ ও নির্মাণ কাজ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ স্থপতি ইনিস্টিউটের পূর্ন সদস্য স্থপতির অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা রয়েছে। সাধারণত ভবনে আলো-বাতাস থেকে শুরু করে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার, শব্দ চলাচলকে সীমিত করা, সর্বোপরি আগুন লাগলে আগুনের বিস্তার ধীরলয়ে করা, কীভাবে দ্রুততম সময়ে এবং কোনো রকমের প্রাণহানি ছাড়া মানুষকে নিরাপদে ভবনের বাইরে আনা যায়, সেই বিষয়গুলো মাথায় রেখে স্থপতিকে নকশা করতে হয়। সেই নকশার উপর দাঁড়িয়ে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়াররা স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করেন।
সরজমিনে দেখা যায়, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বহুতল (৫ তলার অধিক) ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে চলছে এক অদ্ভুৎ নিয়ম, এখানে অধিকাংশ বহুতল ভবন নির্মাণের নকশা করেন ডিপ্লোমা বা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়াররা আর নকশা প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের চাহিদা মেটাতে সম্মানির বিনিময়ে বরিশালের বাইরে অবস্থানরত স্থপতির স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিসিসিতে জমা দেয়া হয়। অথচ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের শুধুমাত্র বহুতল ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন প্রদান করার অনুমোদন রয়েছে কিন্তু ভবনের (৫তলা বা ততোধিক) নকশা প্রণয়ন করার অনুমোদন তাদের নেই। বাংলাদেশ স্থপতি ইনিস্টিউটের পূর্ন সদস্য স্থপতি ছাড়াই বহুতল ভবন নির্মাণের সেবা দেয়ার ফলে প্রকৃতপক্ষে প্রতারিত হচ্ছেন ভবন মালিকরা। এর ফলে শহরে বসবাসযোগ্যতার উপর এক প্রকার বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, যার ফলাফল নগরবাসীকে অত্যন্ত তিক্ততার সাথে বহন করতে হচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন নির্মানাধীন এবং সদ্য নির্মিত বহুতল ভবন ঘুরে এই প্রতিবেদক কিছু উল্লেখযোগ্য এবং দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেন। অধিকাংশ বহুতল ভবনের মালিক কিংবা তদারককারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে এতোদিন ভবন মালিকরা ডিপ্লোমা বা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারকেই স্থপতি হিসেবে জেনে এসেছেন। অধিকাংশ ভবনেই আলো বাতাসের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় নি, আর্গানোমিক্স মেনে ফ্লাটের ভেতর কিংবা বাহিরে জায়গা সংকুলন করা হয় নি। এমনকি সিড়ি ঘরও অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখা যায় কয়েকটি ভবনে। অথচ বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবনের সকল কক্ষে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো প্রত্যেকটি বহুতল ভবনেরই নকশা অনুমোদন কাগজে স্থপতির স্বাক্ষর রয়েছে। বিষয়টি অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক মনে হলে এই প্রতিবেদক বিসিসি কর্তৃক প্রদত্ত নকশা অনুমোদন কাগজে স্বাক্ষর করা কয়েকজন স্থপতির মুঠোফোন নম্বর আইএবি ডিরেক্টরি থেকে সংগ্রহ করে তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। তাদের কেউই সংশ্লিষ্ট প্রজেক্টের নাম কিংবা ভবন মালিকের নাম অথবা ভবন নির্মাণের ঠিকানা কিংবা ভবনটি কয়তলা বিশিষ্ট সেটি বলতে পারেন নি। এই প্রতিবেদক যখন তাদেরকে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকার কথা মনে করিয়ে দেন, তখন তাদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার সর্তে অকোপটে স্বীকার করেন যে তারা এই সকল প্রজেক্টের নকশা করার ক্ষেত্রে তারা যুক্ত ছিলেন না , তারা শুধুমাত্র সম্মানীর বিনিময়ে স্বাক্ষর করেছেন। তারা স্বীকার করে বলেন যে, বরিশালে ভবন ডিজাইনে কাজ করে এরকম কিছু প্রতিষ্ঠানের সাথে শুধুমাত্র নকশা অনুমোদন কাগজে স্বাক্ষর করে দিতে তারা চুক্তিবদ্ধ, শুধু স্বাক্ষর ব্যতীত এই সকল ভবন নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট বাকী কাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররাই করে থাকেন। পরিদর্শন করা প্রতিষ্ঠান গুলোর দ্বারা নির্মানাধীন ভবনগুলোর সাইটে পরিদর্শন করে জানা যায় ভিন্ন কথা। নগরের কাটপট্টিতে এভারগ্রীন বিল্ডিং কনসালেটেন্স এর নির্মানাধীন বহুতল ভবনের ঠিকাদার ও মিস্ত্রিদের কাছে ভবন নির্মানের সময় কোন স্থপতি নির্মানাধীন কাজ পরিদর্শনে এসেছিলেন কিনা জানতে চাইলে? এমন প্রশ্নে তারা বলেন, কাজ চলমানবস্থায় একজন ইঞ্জিনিয়ার সাইটে থাকেন। ওনি স্থপতি না ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার তা ঠিক বলতে পারবো না।
এসোসিয়েশন অব বিল্ডিং কনস্যালটেন্ট বরিশাল এর প্রস্তাবিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডিজাইনার রিয়াদুল আহসান বলেন, বরিশালের প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতিষ্ঠান। আসলে একজন স্থপতি নিয়োগ দিয়ে অফিস পরিচালনা অনেক খরচ সাপেক্ষ। তাই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই স্থপতিদের সাইনিং চুক্তিতে কাজ করায়। স্থপতিদের সাইনিং চুক্তি, নকশা না করা, সাইট পরিদর্শনে না আসা ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলী এবং সিভিল প্রকৌশলীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থপতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উল্লেখ করেন, আসলে কোন স্থপতি যদি সাইনিং চুক্তিতে কাজ করে সেটা পজিটিভলি দেখাই যায়। তবে সাইট পরিদর্শন করার বিষয়টি এটা ওই প্রতিষ্ঠানের উপর দায় বর্তায়। এবং কোন প্রতিষ্ঠান যদি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী এবং সিভিল প্রকৌশলীদের স্থপতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় তাহলে সেটা প্রতারণার। এবং এর প্রমান পেলে তদন্ত করে সেই সকল প্রতিষ্ঠানে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
এবিষয়ে বরিশাল নগরীর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মিলন এন্ড মিলন্স এর স্থপতি ও বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট এর পূর্ন সদস্য স্থপতি মিলন মন্ডল এর সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, বরিশালের অধিকাংশ বিল্ডিং ডিজাইন ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কিছু অসাধু স্থপতিদের টাকার বিনিময়ে স্বাক্ষর ক্রয় করে থাকেন। ফলে বরিশালের বিল্ডিং ডিজাইন ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমত কাজ করে। তাই ভবন করতে আগ্রহীদের উচিত নিজেদের সচেতনতা তৈরী করা। আর যে সকল স্থপতিরা অর্থের বিনিময়ে নিজের স্বাক্ষর বিক্রি করেন তাদের নিজেদের ঠিক না পর্যন্ত এ সমস্যা থেকে বের হওয়া সম্ভব না। পাশাপাশি নকশা অনুমোদন কর্তৃপক্ষের উচিত এসকল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা বলে মন্তব্য করেন।
অপরদিকে বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট এর পূর্ন সদস্য এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আহম্দে এসোসিয়েটস এর প্রধান পরামর্শক স্থপতি নূরুল হাসান সাক্ষর বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বরিশালে ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে এরকম এক ধরনের বিতর্কিত পদ্ধতি চালিয়ে যাচ্ছেন বরিশালের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান। যার ফলে প্রকারন্তরে ক্ষতিটা হচ্ছে বরিশাল নগরীর। কেননা, স্থপতির পূর্ণ সম্পৃক্ততা ছাড়া, কখনই বসবাসযোগ্য বহুতল ভবন গ্রহনযোগ্যতা পায়না। এব্যাপারে বরিশাল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের আরো সচেতন হওয়া জরুরী। কারন এরকম ভবন নির্মানের ফলে পরিশেষে বরিশাল নগরীই বসবাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © All rights reserved © 2024 DailyBiplobiBangladesh.com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com